ছোট গল্প : দেবলীনা, শুভম আর সেলফি

লেখক – প্রীতম ভট্টাচার্য (ত্রিপুরা)

তোর এই মোবাইল টা দিয়েই কি রাজকন্যা সংযুক্তা মহারাজ পৃথ্বীরাজ কে কল করত? না কি আলাউদ্দিন খিলজি পদ্মাবতী কে বিরক্ত করত? এ যুগে কেউ এমন মোবাইল ব্যবহার করে? প্রচণ্ড বিরক্তির সুরে একথা বলে উঠল সমীরণ। যাকে তাচ্ছিল্য করে কথা গুলো বলা হল, তার নাম শুভম। আর যে মোবাইল টা নিয়ে কথা গুলো বলা হল, সেটা একটা নোকিয়া ১১০০ মডেলের মোবাইল।

নিরীহ গলায় শুভম বলল- কি অসুবিধা এতে? ভালইতো কথা বলা যায়।

  • ফোন কি শুধু কথা বলার জন্য রে ? এটা দুই হাজার বিশ। এ যুগে এমন মোবাইল কেউ ইউজ করে? শালা, এটাকে তুই মিউজিয়াম এ কাঁচের বাক্সে  রেখে আয়।আর জায়গা হলে সাথে তুই ও ঢুকে বসে থাকিস।

শুধু মোবাইল নয়। পোশাক, জুতো সব দিক দিয়ে শুভম অতি সাধারণ। অবনত আর্থিক অবস্থা বাল্যকাল থেকেই তাকে খরচা বিমুখ করে ফেলেছে।তাই কেউ কিছু বললে সে চুপ করে সহ্য করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। কোন কিছু না বলে চুপ করে বসে আছে শুভম।

ক্লাসের মাঝামাঝি ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়। ভিড়টা হচ্ছে দেবলীনা কে ঘিরে। আর হবে নাই বা কেন? জিমনাস্টিকে কমনওয়েলথ গেমসে রুপা জিতেছে যে। দীপা কর্মকারের পর আবারো ত্রিপুরার সাফল্য। ত্রিপুরার প্রায় সমস্ত খবরের কাগজে তার খবর বের হয়েছে। টিভি তে খবর দেখানো হচ্ছে।বাড়ির লোকদের সাক্ষাৎকার দেখানো হচ্ছে।  শুভম অবশ্য কলেজে এসেই খবরটা জেনেছে। কারণ টিভি সে দেখে না আর পত্রিকা সে বিকালে পড়ে নজরুল গ্রন্থাগারে বসে।

সুন্দরীরা এমনিতেই পরিচিতি পায়। আর সাফল্য পেলে পরিচিতি কয়েকগুন বেড়ে যায়। দেবলীনার ক্ষেত্রে ও এই সনাতন সত্যের ব্যতিক্রম হয় নি।

ছোটবেলায় একসাথেই জিমনাস্টিক শিখত শুভমও। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর খরচা কমানোর পরিকল্পনায় জিমনাস্টিক শেখা বন্ধ হয়ে যায়। দেবলীনার এই সাফল্যে শুভমের মন যে জ্বালা করছে না, সে কথা বললে ভুল হবে। তবে এই আগুন নেভাতে দেবলীনার একটু স্পর্শই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু দেবলীনা এখন ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। ক্লাসের ছেলেমেয়ে গুলো মোবাইল হাতে দেবলীনার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত। সবার সাথে তো একসাথে সেলফি তোলা যায় না। তাই বিষয় টা কন্ট্রোল করছে পাঞ্চালী।একে একে সবাই লাইনে আসছে।  

শুভম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেবলীনার দিকে। দেবলীনা মাঝে মাঝে দেখা দেয় আবার মাঝে মাঝে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়। দেবলীনা অবশ্য বরাবরই এরকম। বারেবারে হারিয়ে যায়। দেবলীনা দের বাড়ির তিনটি বাড়ি পরেই শুভম দের বাড়ি। শুভমের পড়ার টেবিলের সামনের জানলাটা দিয়ে দেবলীনাদের বেলকনি দেখা যায় কারণ শুভমদের হাফ ওয়াল আর দেবলীনাদের দুতলা ।বিকালের দিকে শুভম তাকিয়ে থাকত। দেবলীনা মাঝে মাঝে বেলকনিতে আসতো। সেই অপেক্ষায় শুভম তাকিয়ে থাকত পুরোটা বিকাল।শুধু একবার দেখার জন্য। স্কুল এক হলে অবশ্য বারেবারে দেখা করা যেত। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তারা এক সাথেই পড়ত। পরে শুভমকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানো হয়।

শুভমের পিঠে একটা থাপ্পর মেরে সমীরণ বলল-  কি রে, তুই সেলফি তুলবি না? শুভমের মনের খবর সমীরণ জানে।কথায় কথায় শুভমই একদিন বলেছিল।  তাই কথাটার মাঝে একটু খোঁচা অনুভব করল শুভম।

শুভম বলল- আমার এসব পছন্দ না।

সমীরণ হেসে বলল- এ যে আঙ্গুর ফল টকের মত অবস্থা। তোর এই ধ্যাতরা মার্কা মোবাইলে কি সেলফি উঠবে?

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শুভম বলল- কি আর করব? তোরা হলি গাড়ি আর আমি হলাম বাই সাইকেল। তোরা অস্ট্রিচ এর ডিম তো আমি মাছের ডিম। তোদের সাথে আমার কি তুলনা?

রীতি মত জোরেই শুভমের পিঠে থাপ্পর লাগিয়ে সমীরণ বলল- খুব কথা বলা শিখেছিস দেখছি। দেবলীনা শিখিয়েছে নাকি?এখন আর চেষ্টা করে লাভ নেই বাপু। জিমনাস্টিকে রুপা বাপু। রুপা।  

কিছু উত্তর করলে সমীরণ আরও উল্টাপাল্টা কথা বলবে। তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

শুভমের মনে পরে ছেলেবেলার কথা। সেই কবে থেকে দেবলীনার সাথে তার পরিচয়। এক টিফিন বক্স থেকে খাওয়া, পেন্সিল ভেঙ্গে শেয়ার করা। কলেজ ভর্তির নামের তালিকার দেবলীনা সরকার নাম টা দেখেই শুভমের আনন্দের আর সীমা ছিল না। ঈশ্বর যেন ইচ্ছা করেই ওদের আবার একসাথে এনেছেন।

কলেজের প্রথম দিনে শুভমকে দেখে দেবলীনাও খুশীই হয়েছিল। বলেছিল- ভালই হল। আমি যদি কোনদিন কলেজে না আসি তোর থেকে নোট গুলো নিতে পারবো। সেই আশায় শুভম কোনদিন কলেজ বন্ধ করত না। যদি কোনদিন দেবলীনা কলেজ বন্ধ করে, শুভমের কাছে নোট চায়। খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশুনায় ও দেবলীনা ভাল, তাই স্কুল বন্ধও করত না। একবার জিমনাস্টিক এর ন্যাশানাল মিটের জন্য দেবলীনা এক সাপ্তাহ কলেজে না এলে দেবলীনার বাড়ি গিয়ে নোট দিয়ে এসেছিল শুভম। হাত ধরে থাঙ্ক ইউ বলাতে শুভম দু দিন ঘুমাতে পারেনি। দেবলীনাকে শুভম অসাধারণ কিছু মনে করত। সেই দেবলীনা যখন সবার কাছে অসাধারণ হয়ে গেছে তা মনে মনে সহ্য করতে পারছে না শুভম। সে ভেবেছিল কমনওয়েলথ থেকে ফিরলে দেবলীনা কে মনের কথাটা বলবে। প্রেমের সম্পর্ক তৈরি না হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তবু মনের কথা মনে আর কতদিন রাখবে? কোন না কোন দিন বলতে তো হবেই ।সেখান থেকে ফিরে দেবলীনা যে রাতারাতি স্টার হয়ে যাবে, সে কথা কে জানত?

হটাত করে শুভমকে হাতে ধরে সমীরণ টেনে নিয়ে গেল দেবলীনার কাছে। শুভমের যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কি মনে করে নিষেধ ও করতে পারেনি।

শুভমকে দেখেই পাঞ্চালী বলল- কি রে, তুইও ছবি তুলতে এসেছিস নাকি? তোর এই দেড়ব্যটারী মোবাইলে তো ক্যামারা নেই। তবে, ফটো তুলবি কি করে?

একথা শুনে আশেপাশের সবাই হেসে উঠল। ভিড়ের মাঝখান থেকে দেবলীনা তাকিয়ে রইল শুভমের দিকে। এত হাসি খুশির মাঝে ও তার মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল।

সমীরণ বলল- শুভম আমার মোবাইল থেকে সেলফি তুলবে। তোদের কোন আপত্তি আছে?

সমীরণ নিজের মোবাইল টা শুভমের হাতে দিয়ে বলল- নে। ছবি তোল।

দেবলীনা রাগের গলায় বলল- না আমি ফটো তুলব না।

শুভমের কান্না আসছিলো। সবার সামনে এ কথা বলতে পারল দেবলীনা। ওর বাবা যেদিন অসুস্থ হয়েছিল বৃষ্টি ভিজে ভিজে ঔষধ আনতে গিয়েছিল শুভম। দেবলীনার টোস্ট পছন্দ বলে রোজ টিফিনে টোস্ট বানিয়ে দেওয়ার আবদার করত শুভম। আর আজ দেবলীনা বলে কি না, সে শুভমের সাথে ছবি তুলতে চায় না।সুন্দরী,পড়াশুনায় ভাল, তার উপর আবার কমনওয়েলথ, অহঙ্কারে পা মাটিতে পড়ছে না দেবলীনার।

বেঞ্চ থেকে উঠে আচমকা শুভমের হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে দেবলীনা বলল- মন খারাপের কি আছে? আমি বলেছি সমীরণের মোবাইলে তুলব না। তোর সাথে আমি আমার মোবাইলে ছবি তুলব।

শুভমের শার্টটা টেনে ধরে মুখটাকে কাছাকাছি এনে সেলফি নেওয়ার পোজ দিয়ে দেবলীনা বলল- এবার একটু হাসি মুখ কর। না হয় ছবিতে বাজে দেখাবে।ভাববে তোকে আমি মারছি।  

হটাত করে দেবলীনার ঠোঁটের স্পর্শে আগুন জ্বলে উঠল শুভমের গালে। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি।চুমুটা   দেবলীনাই দিয়েছে না কি কেউ ধাক্কা দিয়েছে?কারোর দিকে তাকিয়েই কিছু বুঝতে পারছে না শুভম।        

Leave a Reply

Your email address will not be published.