ছোট গল্প : এক সন্ধ্যায়

লেখক – প্রীতম ভট্টাচার্য (ত্রিপুরা)

সন্ধ্যা ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট।শীতের দিন। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সূর্য ডুবে যায়। আজকে শীত অন্য দিনের চেয়ে একটু কম হলেও অরিজিত এখনও দুটো কম্বল গায়ে  জড়িয়েও বেশ কাপছে । বিছানায় কেউ বসে থাকলে বলবে ভূমিকম্প এসেছে ।

গতরাতে হুট করেই শরীরের গরম হওয়াকে পাত্তা না দিলেও জ্বর ঠিকই সকালের দিকে একদম জেকে বসেছে।উঠতে গিয়েও বেশ কয়েকবার উঠতে পারছে না অরিজিত।শরীরটাও বেশ ব্যাথা ব্যাথা ভাব । বিছানায় আরও একটু শুয়ে থেকে কম্বলটা গা থেকে সরাতেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। এ ঘরের কলিংবেলটা এর আগে কবে বেজেছে অরিজিতের ঠিক মনে পড়ছে না। এক সাপ্তাহ তো হবেই। আসলে এখানে পরিচিত বলতেও কেও নেই,হয়ওনি  তেমন।অনেক কষ্টে একটু এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই অরিজিত দেখল নিশা দাড়িয়ে।

নিশাকে এখানে এভাবে দেখে অরিজিত মোটেও অবাক হয় নি।তবে অরিজিত অবাক হয়েছে ওর আসার সময়টা  দেখে। অরিজিত ভেবেছিল মেয়েটা আরও কিছুক্ষণ আগে আসবে।কিন্তু এসেছে তারও বেশ কিছুক্ষণ  পর।নিশা  রুমে ঢুকতে ঢুকতে অরিজিতের দিকে তাকিয়ে বলল – এখন জ্বর কেমন?

অরিজিত আস্তে করে বলে-প্রায় চলে গেছে।

অরিজিতের  কথায় নিশা কোন উত্তর দেয় না।দরজা আটকে অরিজিতের  কপালে হাত রাখে।তারপর গলায়,একটু নিচের দিকে এসে বুকে।ততক্ষণে নিশা অরিজিতকে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে।নিশা আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বেশ রাগি গলায় বলল-  ঠিকঠাক মিথ্যেটাও বলতে পারো না।বললে তো সামান্য জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। এটা তোমার সামান্য জ্বর? জ্বর তো আরও বেড়ে গেছে। ওষুধ খেয়েছো?

নিশার  কথায় অরিজিত আবারো চুপ করে থাকে।সে চায় না নতুন করে আবার মিথ্যে বলে ধরা খেতে।অরিজিতের চুপ থাকা দেখে নিশা একটু রাগের গলায় বলল- খাওনি, তাই না।দুপুরে খেয়েছিলে কিছু? দেখে তো মনে হচ্ছে সেটাও খাওনি। কত বার বলেছি একটা রান্নার লোক রাখ। আর সিদ্ধ ভাত রান্না করতে কি এমন অসুবিধা হয় শুনি?

অরিজিত আবারো চুপ। কি বলবে? তার কিছুই বলার নেই। সত্যিই তো সে দুপুরে কিছু খায় নি।

নিশা এবার অরিজিতের  পাশে বসে হাতটা শক্ত করে ধরে বেশ অভিমানী কণ্ঠেই বলে-

-এভাবে না খেয়ে থাকলে চলবে, বলো? আমার যে খারাপ লাগে তুমি বুঝ না?

অরিজিতের  উত্তরের অপেক্ষা  না করে উঠে দাড়ায় নিশা । সে টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই অরিজিত বুঝতে পারে নিশা  কিছু একটা এনেছে।কিন্তু তার আগে নিশার  হাতের ব্যাগটা অরিজিত  খেয়াল করিনি।কখন টেবিলে রাখলো সেটাও বুঝতে পারে নি ।তবে ব্যাগ থেকে যখন সবকিছু বের করল, ততক্ষণে  এটুকু বুঝা গেল যেটা এনেছে সেটা অরিজিতের  কাছে নিশার মতই পছন্দের।

নিশা প্লেটে বিরিয়ানি বাড়তে বাড়তে বলল – কোচিং থেকে এসে তোমার জন্য এটা রান্না করতে করতেই দেরী হয়ে গেলো। নিজে খাবে নাকি খাইয়ে দেবো?

নিশার এমন কথায় অরিজিতের  কিছুই বলার নেই, সে মুচকি হাসে ।অরিজিতের মুচকি হাসি দেখে নিশা ও হাসে।নিশা  ততক্ষনে বুঝে যায় ওর হাতে খাওয়াটা অরিজিত  মিস করতে চাইছে না।নিশা  আর কিছু না বলে অরিজিতের পাশে এসে বসে।অরিজিত তাকিয়ে থাকে নিশার  দিকে।একদৃষ্টিতে ।নতুন করে কোন কিছুই চাওয়ার নেই নিশার কাছে।নিশা অরিজিতের পাশে আছে, এটাই অরিজিতের জন্য যথেষ্ট।  

অরিজিত একা। একা মানে একাই। বাবা মা কে দেখেনি কখনো। ছোট বেলা অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। এখন অবশ্য সরকারি চাকুরি করে। অনাথ আশ্রমে আর থাকে না।ভাড়া থাকে । নিশা তার সহপাঠী। নিশাও অনেকটা একাই বলা চলে। বাড়িতে শুধু মা। বাবা মারা গেছেন সেই ছোট বেলা, সে যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত। বাবা চাকরি করত পুলিশে। সেই চাকরিটাই মা পেয়েছে। অরিজিতের সাথে ও নিশার আলাপ সেই ক্লাস সেভেন থেকেই। নিশার মা প্রেম শুরুর বছর খানেক পর থেকেই ঘটনাটা জানতেন। আপত্তি করছেন সেই প্রথম থেকেই, বাবা মা’র পরিচয় নেই। হিন্দু না মুসলিম জানা নেই। এমন একটা ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে কিভাবে দেবেন তাই নিয়ে তার ঘোর আপত্তি। প্রথম প্রথম অবশ্য তিনি ততটা গুরুত্ব দেন নি, ভেবেছিলেন স্কুল জীবনের প্রেম হয়ত পরে আর থাকবে না। কিন্তু উনার ধারণা ভুল প্রমানিত করে এক যুগ পেরিয়ে এই বন্ধন আরও সুদৃঢ়। প্রথম প্রথম অরিজিত সম্পর্কে কিছু উল্টাপাল্টা তর্ক করলে নিশা আপত্তি করত। এখন আর তা করে না। শুনেও না শুনে থাকে।

আজকেই মন্দকি বিরিয়ানি রান্না করতে দেখে মা আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে, অবশ্য তাতে বিরিয়ানি রান্নার মনোযোগ ব্যাহত হয় নি। তার প্রমাণ  অরিজিত বলল- আমি ভাবছি তোমার শুধু শুধু চাকরির চেষ্টা না করে বিরিয়ানির দোকান খোলা উচিত। নাম ও আমি ভেবে রেখেছি।নিশা’স বিরিয়ানি।

চামচ দিয়ে ঠোটের কোনটা পরিস্কার করতে করতে নিশা বলে-তোমার যত সব ফালতু কথা। জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলে নিশা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় অরিজিত কে।  

বিরিয়ানি খাইয়ে অরিজিতকে ওষুধ খাওয়ানোর পর নিশা যখন বের হবে তখন কেন যেন ওকে একা ছাড়তে ইচ্ছে হলো না অরিজিতের।রাত তেমন হয়নি। এমন রাতে নিশা একাই চলাফেরা করে। বাড়ি ও বেশি দূরে নয়। নিশার সাথে সাথে অরিজিতও বেড়িয়ে পড়ল।অবশ্য এতে নিশার  অনেক রাগ।যেখানে জ্বর নিয়ে  অরিজিত উঠতেই পারছে না  সেখানে ওর সাথে এই শীতের রাতে বের হওয়াটা নিশা মানতে নারাজ।

কিছু দূর যাওয়ার পর নিশা  অরিজিতের দিকে তাকিয়ে আবারও মলিন মুখে বলে- যাও এবার।এসে গেছি তো। তোমার আর আসতে হবে না।

নিশার কথায় অরিজিত  কিছু বলে না । আশেপাশে তাকায় ।মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি দেখা গেলেও লোকজনের দেখা নেই।অরিজিত  নিশার  দিকে আরও একটু এগিয়ে যায় ।নিশা  অরিজিতকে কে হাত বাড়িয়ে ধরে।কিন্তু অরিজিতের  সেদিকে কোন খেয়াল নেই।অরিজিত শুধু  তাকিয়ে থাকে  নিশার  মায়া মাখা মুখটার দিকে।হুট করেই নিশা কে কাছে টেনে নেয় অরিজিত ।জড়িয়ে ধরে  বেশ শক্ত করে।অরিজিতের  জড়িয়ে ধরাটা নিশার  হয়তো খুব একটা পছন্দ হয়নি।নিশা বেশ রাগি গলায় বলে, “এত আস্তে করে সহজ ভাবে কেও জড়িয়ে ধরে!আমি কি তোমার বন্ধু নাকি? জড়িয়ে ধরতে হয় এভাবে।কথাটি বলেই নিশা  অরিজিতকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অরিজিত হাসতে হাসতে বলে , একটু আগে ঘরে যখন আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তখন সরে গেছিলে কেন?

অরিজিতের কানে হাল্কা কামড় দিয়ে নিশা বলল- প্রেম যখন করিই তখন আর লুকিয়ে করার কি আছে?

ঠোঁটে ঠোঁট  খুঁজে নিয়ে অরিজিত বলল- এরকম হাজারটা শীতে আমি জড়িয়ে থাকতে চাই তোমার সাথে।হ্যা তোমার সাথে। তবে আমার কিন্তু জ্বর। আমার এই ছোঁয়াচে জ্বর তোমার হলে? আমি কিন্তু বিরিয়ানি রান্না করতে পারি না।

ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে, হাতের বাধন একটু শিথিল করে নিশা বলল- ধুর।ফালতু কথা বললে কামড়ে দেবো। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.